শুরু
নদীর ধারে বসে থাকা এই ছেলেটির নাম অর্ক। বয়স বিশের কোঠায়, চোখে সবসময় একধরনের খোঁজ—যেন কিছু একটা হারিয়েছে বহুদিন আগে। ছোট শহরের ছেলে হলেও তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। কিন্তু সব স্বপ্ন যেমন উঁচু আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, অর্কের স্বপ্নগুলো ধাক্কা খেয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে। সে এখন শহরের একটি ছোট লাইব্রেরিতে কাজ করে। বইয়ের গন্ধ, ধুলোয় ঢাকা পুরোনো পৃষ্ঠা, আর নিঃসঙ্গ দুপুর তার নিত্যসঙ্গী।
রহস্যের শুরু
একদিন, লাইব্রেরির এক কোণে অর্ক একটি পুরোনো বই খুঁজে পায়—”আলোর পথযাত্রী”। বইটা যেন কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা, কিন্তু ঠিক কার জন্য তা স্পষ্ট নয়। বইয়ের শেষ পাতায় লেখা একটি বাক্য তাকে কাঁপিয়ে দেয়:
“যদি সত্যিই খোঁজো, তবে সন্ধ্যা ছটার সময় সেই পুরোনো পাখির ঘড়িটার দিকে তাকাও।”
অর্ক জানে, লাইব্রেরির এক কোণে একটা পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ি আছে যেটার পাখির দরজা বহু বছর ধরেই বন্ধ। মজার ব্যাপার হলো, বইয়ের লেখক ছিল “আনন্দ কিশোর”, যে এই শহরেরই এক সময়কার বিখ্যাত লেখক, কিন্তু হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান।
সন্ধ্যার ছটা
পরদিন ঠিক ছটার সময়, অর্ক ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘড়ির পাখির দরজা খচ করে খুলে যায়—এটা অর্কের কল্পনা নয়, সত্যিই ঘটে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো পাখি বের হয় না। বরং একটা ছোট চিরকুট পড়ে যায় নিচে। চিরকুটে লেখা:
তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, তবে কাল রাতে নদীর ঘাটে এসো। একা। চাঁদের আলোয় সত্য ধরা দেয়।”
অর্ক দ্বিধায় পড়ে যায়, কিন্তু কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যায়।
নদীর ঘাটে
রাত ১২টা। নদীর ঘাট একেবারে নীরব। শুধু জল আর চাঁদের আলো। হঠাৎ অর্ক দেখে, একজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছে। সাদা ধবধবে চুল, চোখে গভীর দৃষ্টি। “তুমি অর্ক?” অর্ক কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি আনন্দ কিশোর?” বৃদ্ধ শুধু মাথা নাড়েন। “তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছো কারণ তুমি প্রশ্ন করেছো, অন্যরা করেনি।”
গোপন কাহিনি
আনন্দ কিশোর বলেন, “এই শহরে এমন কিছু আছে যা কেউ জানে না। শহরের মধ্যেই লুকানো একটি গুহা—যেখানে ‘আলো’ আছে, এমন এক আলো যা সত্য দেখায়। কিন্তু অনেকেই সেখানে পৌঁছে অন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সত্য দেখতে সবাই প্রস্তুত নয়।” অর্ক বলে, “আমি প্রস্তুত।”
আলোয় ডুব
বৃদ্ধ লোকটি অর্ককে নিয়ে যায় শহরের প্রান্তে, এক পরিত্যক্ত মন্দিরের নিচে। সেখানে একটি সিঁড়ি, যা সরাসরি গুহার দিকে যায়। ভেতরে ঢুকতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি অর্ককে ঘিরে ধরে। দেয়ালে লেখা: *“নিজেকে জানো, তাহলেই পৃথিবী তোমার হবে।”* গুহার একদম শেষে একটি আলোকিত আয়না। কিন্তু সেটা সাধারণ আয়না নয়। ওতে দেখা যায় নিজের অতীত, ভুল, লুকানো ভয় আর অব্যক্ত সত্য। অর্ক দেখে তার শৈশব, বাবার হারিয়ে যাওয়া, তার মায়ের চোখে জল, তার নিজের দোদুল্যমান স্বপ্ন। এবং সে বুঝতে পারে—এই আলো কোনো যাদু নয়, বরং নিজের ভেতরের আলো। **৭. প্রত্যাবর্তন** আনন্দ কিশোর বলে, “এই গুহা যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ আশা করতে পারবে। কিন্তু ভুলে যেও না, সত্য জানার চেয়ে কঠিন হলো সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা।” অর্ক ফিরে আসে। সে আর আগের মতো থাকে না। সে নিজের ভেতরের ভয়কে গ্রহণ করে, ভুল থেকে শেখে, আর সেই আলোকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। লাইব্রেরিতে সে এক কোণ তৈরি করে—যার নাম দেয় “আলোর কোণ।” যেখানে কেউ এসে নিজের গল্প লিখতে পারে, কাঁদতে পারে, আবার হাসতেও পারে।
শেষ কথা
বছর কেটে যায়। একদিন এক কিশোর এসে লাইব্রেরির ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্ক তাকে দেখে হাসে। “তুমি কি খুঁজছো?” কিশোর মাথা নাড়ে। অর্ক বলে, “তাহলে শুরু করো। সব আলো একদিন একটা প্রশ্ন থেকেই জ্বলে ওঠে।